সাতাশ দিনের রমিজকে নিয়ে রমিজের দাদা ছেলের বৌ সহ ঢাকা আসে প্রায় কুড়ি বৎসর আগে। দাদা যে বাড়ির দারোয়ান মা সেই বাড়িরই কাজের বুয়া। দাদা, মা আর রমিজ এই বাড়িতেই থেকেছে দাদা মারা যাবার আগ পর্যন্ত।
কিশোর রমিজ মা’র চাকরি হারাবার পর উঠে এসেছে ভাসানটেকের এই বস্তিতে। বনানীর অভিজাত বাড়ি-ঘরের স্বাদ-রূপ ছেড়ে এই বস্তিতে এসে ভালো লাগেনি মোটেও। সব্জি বিক্রেতা জব্বারের কাছে রমিজকে কাজে দিয়ে মা যখন
বাড়ি-বাড়ি ছুটা বুয়ার কাজ করে বেড়ায় রমিজের হাহাকার তখন আকাশে বাতাসে মিশে যায়। সারাদিনের প্রচন্ড পরিশ্রমের পর ক্লান্তিমাখা রাতের ঘুমে মাঝে মাঝে রমিজ মাকে পাশে পায়। ঘুম চোখে মাকে জড়িয়ে ধরে হলুদ মরিচ আর ঘামের গন্ধের আঁচলটি মুড়ি দেয়। রমিজ স্বপ্নে দেখে তার বাবাও ঘুমিয়ে আছে পাশে। বাবা, বাবা বলে ডেকে ওঠে ঘুমের মাঝে। বুকে ঝাপটে ধরে মা তখন ভাবে, ছেলে তো বাবাকে দেখেনি কোনোদিন। ডাকেওনি কোনোদিন। তবে আজ কেনো বাবা, বাবা বলে হাহাকার করে ডাকছে? রমিজেকে ঝাপটে ধরে বুকে কান্নায় দু’চোখ ভিজে যায় মার।
বাবা বলে ডুকরে কেঁদে ওঠা নিয়মিত হতে থাকলে একদিন মা সাত সকালে কাজে না গিয়ে ঘরেই বানায় সকালের নাস্তা। রুটি ভাজি পরম মমতায় তুলে দেয় ছেলের মুখে। আর জিজ্ঞেস করে রমিজ তুই প্রতিরাতে বাবা বাবা বলে ডাকিস; তুই তো বাবাকে দেখিসইনি। তুই কি স্বপ্নে দেখিস তোর বাবাকে?
রমিজের ঘাড় ঝুলে পরে বুক বরাবর। কান্নায় ফোঁপাতে থাকে। মা-ছেলে রুটি হাতে জড়িয়ে ধরে দাঁড়িয়ে থাকে অনেকক্ষণ।
রমিজ, তুই কি জানিস আমাদের সমৃদ্ধশালী একটা সংসার ছিলো। দুধের গাভী ছিলো, চাষের বলদ ছিলো, পুকুরে মাছ ছিলো। বন্যায় সব ভেসে গেছে। ভেসে গেছে তোর বাবা। তোর অন্য সব আত্মীয় স্বজন। তোর মাকে নিয়ে তোর দাদা কিছুদিন পর ঢাকা চলে আসে। দাদা মারা যাওয়ার পরের ইতিহাস আরো করুণ।
থামো মা থামো। বহু শুনেছি তোমার এই গল্প। বহু কিছু দেখেছি।
কী রমিজ! বেলা বাজে আটটা। তোর কোনো খবর নাই। ঘুমাইয়া আচোস মাঙ্গেরপুত।
রমিজ তড়াক করে লাফিয়ে উঠে দাঁড়ায়। কড়া একটা জবাব দিতে চায়, ঐ শালাকে। জানে মার খাওয়ার একশত ভাগ সম্ভাবনা, তবুও। মা-ই চিল্লিয়ে উঠে, ওই জব্বার, সাবধানে কথা কস। মুখ সামলাইয়া কথা ক’! আমার পোলারে গাইলাবি না কুত্তার বাচ্চা। রমিজ মাকে থামায়। জামা গায় দেয়, মুখ মুছে, কাজে যায় জব্বারের পিছন পিছন।
ঐ যে দেখ আমার পোলায় সেই সক্কাল বেলা স্কুলে রওয়ানা দিছে গোসল কইরা, ড্রেস পইরা। তুই তো খালি ঘুমাস।
মারে পাইয়া ঘুম আরো বাইড়া গেছে হালা। রমিজ কথা বলে না। মা ঘরের দরজায় দাঁড়িয়ে দ্যাখে ওদের যাওয়া। বুক
ফেটে যায়।